এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরির শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন সংবাদের বড় অংশ জুড়ে থাকে সৌদি আরব থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার খবর। তাদের অনেকে লাশ হয়ে, কেউবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন। রানা প্লাজার বীভৎসতা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কতটা অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করে আমাদের কর্মীরা।
সবচেয়ে কম মজুরি আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করে বাংলাদেশের শ্রমিক। যেকোনও উৎসবে মালিক যখন প্রমোদভ্রমণে যান, তখনও হয়তো শ্রমিকের তিন মাসের বেতন বাকি। কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় না আর সরকার খাদ্য উদ্বৃত্তের গল্প শোনায় মানুষকে। দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায্য আন্দোলন করতে গিয়ে কৃষকের সন্তান খায় হাতুড়ির বাড়ি, যায় রিমান্ডে, শোনে ৩৮ টাকায় খাবার আর ১৫ টাকায় বাসস্থানের খোটা। সরকারের একবারও মনে পড়ে না এই সাধের বিশ্ববিদ্যালয় চলে আমাদের টাকায় যেখানে মিশে আছে কৃষক, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের ঘামেভেজা রক্ত জল করে আনা টাকা।
জনগণের টাকায় একদিকে লুটেরা শ্রেণি বছরে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার করে আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠান আমাদের প্রবাসী ভাইরা। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে— গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের দুই গুণ। আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে— বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে। যদিও রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা।
আইন করে ব্যাংকগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে এক একটি পরিবারের হাতে। মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে ব্যাংক। এখন ব্যাংকের নীতি নির্ধারিত হয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি কার্যকর করে মাত্র। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তো নিজের ভারবহনে সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। নজীরবিহীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নাই হয়ে গেছে ৮০০ কোটি টাকা, যার বিচার তো দূরস্থান, তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। এদিকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপী ঋণ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ।
সরকারের লোক কথায় কথায় চীন ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টেনে বলতে চায়, সেখানে তো গণতন্ত্র নেই, কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার, সেসব দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকলেও উন্নয়ন হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অন্যদিকে পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন দুটোরই ঘাটতি ছিল। ফলে উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমন ফিলিপাইন কিংবা জিম্বাবুয়ে। সেইসব দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্র আর সুশাসনের চরম ঘাটতি আছে।
প্রশ্ন জাগে, এত উন্নয়নের পরও সরকার কেন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পারছে না? এটা প্রমাণিত যে সুশাসনের অভাব মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে বিনিয়োগ বিমুখ করে তোলে। গণতন্ত্র আর সুশাসনহীন উন্নয়নের ছোট্ট একটি উদাহরণ হলো— বিশ্বে নজিরবিহীন ব্যয়বহুল রাস্তা নির্মাণ হয় বাংলাদেশে, অথচ সবচেয়ে খারাপ রাস্তার তালিকায় এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, ঘরে ঘরে উন্নয়নের খবর পৌঁছে দিতে। বলেছেন, যত উন্নয়ন তিনি করেছেন তাতে মানুষের ভোট না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। ভোট না দিলে বুঝতে হবে উন্নয়নের প্রচার সঠিকভাবে হয়নি। প্রকৃত উন্নয়ন যা গণমানুষের জীবনকে উন্নত করে তা প্রচারের জন্য মাইক বা বিলবোর্ড লাগে না। মানুষ আপনাআপনি তার সুফল পায়, মনেও রাখে।
কিন্তু যে উন্নয়ন কেবল গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে, যাতে সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জোটে না, তেমন উন্নয়নের প্রচার যত জোরেই হোক না কেন তা মানুষকে স্পর্শ করে না। গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও ন্যায্যতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাজ না করে যতই দুর্নীতি আর লুটপাট সহযোগী অবকাঠামোগত উন্নয়নের গল্প শোনানো হোক না কেন, মানুষ কিন্তু ঠিকই বোঝে। কিছু মানুষকে হয়তো কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়। কিন্তু সব মানুষকে সবসময় বোকা বানানো অসম্ভব।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন